এসএম বদরুল আলমঃ বাংলাদেশের সরকারি স্থাপনা নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তর। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি, ঘুষ, টেন্ডার সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য আলোচিত-সমালোচিত। এই অনিয়মের পেছনে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নাম এসেছে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলামের।
ড. মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি রাজনৈতিক প্রভাব, কমিশন বাণিজ্য ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলেই দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনিক শাস্তি ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকেও বেঁচে গেছেন।
কর্মজীবনের শুরু থেকেই মঈনুলের নানা বিতর্ক ছিল। ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর যখন ১৫তম ব্যাচের অন্য সহকারী প্রকৌশলীরা যোগ দেন, তিনি যোগ দেন ৯ মাস পর—১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট। এরপর এক সময় ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা নয় বছর আট মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পরও তিনি চাকরি হারাননি। বরং আপিলের মাধ্যমে পুনর্বহাল হন—যা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভেতরে তাকে “মিস্টার টেন পার্সেন্ট” নামে ডাকা হতো। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি প্রকল্পে তিনি ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন। শুধু তিনটি বড় প্রকল্প থেকেই তিনি শত কোটি টাকার বেশি সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি, বিদেশে ব্যাংক হিসাব ও বিনিয়োগ—সবই তার নামে বা পরিবারের নামে আছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইয়ে তিনি বিপুল অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ড. মঈনুল ইসলামের নাম উঠে আসে কুখ্যাত ঠিকাদার জি কে শামীমের সিন্ডিকেটের সঙ্গেও। র্যাবের হাতে শামীম গ্রেফতারের পর তদন্তে প্রকাশ পায়, গণপূর্তের একাধিক উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী এই সিন্ডিকেটের অংশ ছিলেন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কমিশন ভাগাভাগি, প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ—সবকিছুতেই জড়িত ছিলেন মঈনুল। এমনকি তার ঘনিষ্ঠ প্রকৌশলীরা এক মামলায় ৩১ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।
এই সব অভিযোগ তদন্তে নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০২০ সালের শেষ দিকে দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে। দুদক তার সম্পদের উৎস যাচাই করে অনেক অভিযোগের সত্যতাও খুঁজে পায়।
ড. মঈনুলের দুর্নীতির সঙ্গে আরও যুক্ত ছিল খুলনা অঞ্চলের কিছু কর্মকর্তা। খুলনা গণপূর্ত বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ঠিকাদার মাহবুব মোল্লা লিখিত অভিযোগ দেন—টেন্ডারে অনিয়ম, ঠিকাদার বাছাইয়ে পক্ষপাত ও নিম্নমানের কাজের অভিযোগে। হাসপাতাল, থানা ভবনসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ‘ভুতুড়ে’ মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে এটি কেবল একজন কর্মকর্তার নয়, বরং একটি সাংগঠনিক দুর্নীতির চক্র—যেখানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা মিলে “দুর্নীতির সিন্ডিকেট” গড়ে তুলেছেন। তারা সরকারি প্রকল্পের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে, প্রতিযোগিতা বন্ধ করে নির্দিষ্ট ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয় এবং পরে অর্থ ভাগাভাগি করে নেয়।
ফলে জনগণের করের টাকায় চলা প্রকল্পগুলোর মান দিন দিন কমছে। সৎ ঠিকাদাররা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ভয় পাচ্ছেন, আর সাধারণ মানুষ ভুগছে নিম্নমানের নির্মাণকাজের ভোগান্তিতে।
একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা যখন রাজনৈতিক প্রভাবের আশ্রয়ে বছরের পর বছর দুর্নীতি চালিয়ে যেতে পারেন, তখন এটি কেবল তার ব্যক্তিগত অপরাধ নয়—বরং পুরো প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিফলন। প্রশ্নটা সেখানেই—কোন শক্তি এত বছর ধরে তাকে অদৃশ্যভাবে রক্ষা করেছে?