খুলনা প্রতিবেদকঃ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন এখন এক ভয়াবহ বিপদের মুখে। ম্যানগ্রোভ এই বনজুড়ে দিন দিন বেড়েই চলেছে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের প্রবণতা। ভারত থেকে চোরাপথে আসা নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করে জেলেরা মাছ ধরছে নির্বিচারে। এতে শুধু মাছই নয়, ডলফিন, কাঁকড়া, পাখি, বন্যপ্রাণী—সবকিছুই ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এমনকি বনের গাছপালা, বিশেষ করে সুন্দরীগাছও মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে তালিকাভুক্ত প্রায় ৫,৮০০ জেলে পাশ-পারমিট নিয়ে মাছ ধরেন। কিন্তু দাদনদার বা মহাজনের চাপে অনেক জেলে বাধ্য হয়েই বিষ ব্যবহার করছেন। তাদের দেওয়া ভারতীয় বিষ খালের পানিতে ছড়িয়ে মাছ ধরা হয়। এতে দ্রুত প্রচুর মাছ মেলে বলে তারা এই বিপজ্জনক পথ বেছে নিচ্ছে।
গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে পূর্ব সুন্দরবনের দুই রেঞ্জে বনবিভাগ ২৫০টির বেশি অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে ১৩২ জনকে আটক করা হয় এবং জব্দ করা হয়েছে ৪৫ বোতল তরল বিষ, ৪ কেজি বিষ পাউডার—যার বেশিরভাগ বোতলেই লেখা “মেড ইন ইন্ডিয়া”। উদ্ধার হয়েছে ৬৫৭ কেজি বিষযুক্ত মাছ, ২২ বস্তা বিষে ধরা শুঁটকি, ৩৭৫ কেজি কাঁকড়া এবং শত শত ট্রলার ও জাল।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, মহাজনের দাদনের ফাঁদে পড়েই তারা বিষ ব্যবহার করতে বাধ্য হন। নিষিদ্ধ মৌসুমে যখন আয় বন্ধ থাকে, তখন পেটের দায়ে অনেকেই বিষ মিশিয়ে মাছ ধরে। পরে সেই মাছ বনেই শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়—যার জন্য সুন্দরীগাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এতে গাছও ধ্বংস হচ্ছে, আর বিষের সংস্পর্শে পুরো বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, “বিষ দিয়ে মাছ ধরা শুধু মৎস্যসম্পদ নয়, সুন্দরবনের পুরো প্রাণপ্রবাহের জন্য হুমকি। এতে ডলফিন ও জলজপ্রাণী মরছে, পানির মান নষ্ট হচ্ছে, এমনকি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব পড়ছে।” তিনি আহ্বান জানান, বনবিভাগের হাতে যেন দ্রুত বিষ শনাক্তের কিট সরবরাহ করা হয়, যাতে দোষীদের চিহ্নিত করা সহজ হয়।
বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, হরিণ শিকার রোধে ড্রোন ব্যবহার করে সাফল্য পাওয়া গেলেও বিষ দিয়ে মাছ ধরা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আটক হওয়া প্রায় সব বোতলেই ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ লেখা ছিল, যা থেকে বোঝা যায়, এই অবৈধ কীটনাশক ভারত থেকেই আসছে। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের সহযোগিতা ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
বাগেরহাট জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক মো. মোতাহার হোসেন জানিয়েছেন, সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলা ও শরণখোলা এলাকায় কীটনাশক বিক্রেতাদের ওপর কড়া নজরদারি চলছে। প্রায় ৪০ জন ডিলারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, এবং যারা অবৈধভাবে ভারতীয় বিষ বিক্রি করছে তাদের লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।
সব পক্ষের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া বিশ্বের এই অনন্য ম্যানগ্রোভ বনকে বিষমুক্ত রাখা সম্ভব নয়। এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি হয়তো আর টিকবে না।
