নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেশের অন্যতম মানবিক সংগঠন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, যা দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছাসেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, এখন নিজেই অনিয়ম ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত। প্রায় দেড় বছর ধরে সংস্থাটিতে চলছে গোলযোগ, অভিযোগ আর ক্ষমতার লড়াই। সেবার চেয়ে এখন সেখানে বেশি আলোচিত হচ্ছে দুর্নীতি, বদলি, পক্ষপাত আর দমননীতি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করার পর থেকেই শুরু হয় অস্থিরতা। বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আজিজুল ইসলামের দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যক্তিগত সহকারী নিয়োগ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, নারী হেনস্তার শাস্তি বাতিল, এবং অনিয়মিত বদলি ও নিয়োগ নিয়ে উঠেছে একের পর এক অভিযোগ। এসব বিষয়ে আপত্তি জানানো কর্মকর্তারা হয়েছেন তার রোষানলের শিকার।

সংস্থার ভেতরে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে, নিজ সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান নিজেই গণমাধ্যমে খবর পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের প্রতিবাদ করায় অনেক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীকে হয়রানি বা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগের উপপরিচালক মুনতাসির মাহমুদ বলেন, “স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষের জন্য কাজ করতে চায়, কিন্তু এখন তারা ভয়ের মধ্যে কাজ করছে। আমিও শুধু প্রতিবাদ করায় চাকরি হারিয়েছি।”

চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত ৮ অক্টোবর থেকে একদল কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন করেন। আন্দোলন দমন করা হলেও ক্ষোভ এখনো দমে যায়নি। আন্দোলনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মীকে বদলি বা বরখাস্ত করা হয়।

চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দেওয়া—এসব অভিযোগও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট’ পদে একজন প্রার্থীকে নিয়ম ভেঙে শর্টলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং পরে জানা যায়, তার চাকরির তথ্যই ভুয়া।

বদলির ক্ষেত্রেও চলছে অনিয়মের ছড়াছড়ি। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দূরবর্তী জেলায় পাঠানো হচ্ছে, যেখানে তাদের দায়িত্ব বা পদমর্যাদার সঙ্গে কোনো মিল নেই। এমনকি গাড়িচালকদেরও এমন জায়গায় বদলি করা হয়েছে, যেখানে গাড়িই নেই।

আরও আলোচিত একটি ঘটনা হলো, নারী সহকর্মীকে হেনস্তার অভিযোগে শাস্তি পাওয়া এক কর্মকর্তার শাস্তি নিয়ম ভেঙে বাতিল করা। ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তার ভাষায়, “আমার অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। এক বছর পরে সেটি বাতিল করা হলো—এটি সম্পূর্ণ অন্যায়।”

চেয়ারম্যানের সমর্থকদের প্রমোশন ও চুক্তি নবায়নে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, চুক্তি নবায়ন ও পুনর্বহালের ঘটনাও সামনে এসেছে। এমনকি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও চুক্তিভিত্তিক পরিচালক করে পুনর্বহাল করা হয়েছে “পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।”

সংস্থার অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, যাদের কারণে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা চলছে, তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন চেয়ারম্যান। এতে স্বেচ্ছাসেবক ও যোগ্য কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এক সদস্য ডা. মাহমুদা আলম মিতু বলেন, “আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম বলেই হামলার শিকার হয়েছি। সোসাইটিকে রাজনৈতিকভাবে দখলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।”

চেয়ারম্যানের নিজস্ব পিএস নিয়োগ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে অনুমোদন নিয়ে পরে তাকে পিএস করা হয় এবং কয়েক দিনের মধ্যেই বেতন বাড়ানো হয় দ্বিগুণেরও বেশি—যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত।

এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রেড ক্রিসেন্ট নিজস্ব আইনে পরিচালিত হয়, তাই তারা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে চায় না। তবে বাস্তবে চেয়ারম্যান ও বোর্ড গঠনের দায়িত্বও মন্ত্রণালয়েরই হাতে, ফলে দায় এড়ানো সহজ নয়।

সংস্থার ভেতরে এখন অচলাবস্থা। সেবার পরিবর্তে সময় যাচ্ছে প্রশাসনিক বিরোধ, বদলি, নিয়োগ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে। ফলে দেশের অন্যতম মানবিক সংগঠনটি আজ নিজেই মানবিক সংকটে পড়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *